যে খাবারগুলো কখনোই ফ্রিজে রাখা উচিত না
প্রতিদিন অনেক খাবারই আমরা ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিই তা হোক গ্রীষ্মকাল বা শীতকাল। তা না হলে অনেক খাবারই নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের মাঝে প্রচলিত একটি সাধারণ বিশ্বাস হলো ঠাণ্ডা আবহাওয়া আমাদের খাদ্য উপাদানগুলোর জন্য নিরাপদ এবং আরো বেশি স্বাস্থ্যকর। কেননা নিচু তাপমাত্রা খাদ্যকে নষ্ট করে দিতে পারে এমন সব অণুজীব এবং ব্যাকটেরিয়াকে দমণ করে। আর এই বিশ্বাসের কারণেই আমরা কাঁচা মাংসের মতো খাবার ফ্রিজে রাখি। কিন্তু একই নিয়ম অন্য সব খাবারের বেলায়ও প্রয়োগ করতে গিয়েই আমরা বিপত্তিটা বাধাই। বাস্তবে সব খাবারের বেলায়ই এই নিয়মটা প্রযোজ্য নয়। বেশ কিছু খাদ্য বা সবজি আছে যেগুলো ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রাখলেই ভালো থাকে, আবার এমন কিছু খাদ্য আছে যেগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এমন কিছু খাদ্য রয়েছে যেগুলো ফ্রিজে না রেখে বরং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখলেই বেশি ভালো থাকবে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কোন কোন খাবারগুলো ফ্রিজে রাখা উচিত নাঃটমেটোঃ
টমেটো এমন একটি সবজি যার অনেক গুণাগুণ রয়েছে। এই সবজিটি কাঁচা খেলে দেহের ভিটামিন ও প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়। আবার বিভিন্ন তরকারিতে দিলে তরকারির স্বাদে পরিবর্তন আনে। সতেজ রাখার জন্য অনেকেই টমেটো ফ্রিজে রাখেন। কিন্তু ফ্রিজে রাখলে টমোটোর বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, নিস্তেজ ও ময়দার তালের মতো তুলতুলে হয়ে যায়। তাই ফ্রিজে না রেখে একটা খোলা পাত্রে টমেটো ভরে জানালার পাশে রাখতে পারেন। এতে টমেটো সতেজ ও টুসটুসে থাকবে। অথবা পরিষ্কার কোনো পলিথিন ব্যাগে কিংবা কাগজের প্যাকেটেও রাখতে পারেন। এভাবে সংরক্ষণ করলে টমেটো ৩ দিন পর্যন্ত ফ্রেশ থাকে। তবে পুরোপুরি পেকে গেলে এরপর আপনি টমেটো প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ফ্রিজ রাখতে পারবেন।
![]() |
যে কোন খাবারই ফ্রিজে রাখা স্বাস্থ্যস্মমত নয় |
পাউরুটিঃ
পাউরুটির নিজস্ব আর্দ্রতা রয়েছে। ফ্রিজে রাখলে পাউরুটি আর্দ্রতা হারাতে শুরু করে, দ্রুত শুষ্ক হয়ে শক্ত হয়ে যায়। খেতেও ভালো লাগেনা। তাছাড়া ঠাণ্ডা এবং আর্দ্র তাপমাত্রা রুটি/পাউরুটি আরো দ্রুত বাসি হয়ে পড়তে পারে। তাই পাউরুটি ফ্রিজে রাখবেন না। বাইরেই পাউরুটি ৪ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।রসুনঃ
আপনি যদি ফ্রিজে রসুন সংরক্ষণ করেন তাহলে তা খুব তাড়াতাড়ি অঙ্কুরিত হয়ে যায়। এবং তা রাবারের মতো হয়ে যেতে থাকবে। ফ্রিজে রাখলে এমনকি রসুন অপেক্ষাকৃত নরম হয়ে যায়। সুতরাং শুকনো এবং শীতল স্থানে রসুন সংরক্ষণ করুন। বাইরেই এটি ২ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে রসুন বেটে বা ব্লেন্ড করে ঢাকনাযুক্ত কিছুতে ভরে ফ্রিজে রাখতে পারেন।পেঁয়াজঃ
পেঁয়াজ কেনার পর বাইরে খোলা স্থানে রাখুন কিংবা এমন কোনো জায়গায় রাখুন যেন বাতাস লাগে। তবে পেঁয়াজ সবসময় আলু থেকে দুরে রাখুন। কারণ আলু থেকে আর্দ্রতা ও গ্যাস নির্গত হয়ে থাকে যার জন্য পেঁয়াজ পচে যায়। ফ্রিজের ভিতরের আর্দ্রতা টেনে নেওয়ার ফলে পেয়াজ নরম ও ঝলসা প্রকৃতির হয়ে যায়। ফ্রিজে পেঁয়াজ রাখতে গেলে তা সবসময়ই খোসা ছাড়িয়ে বা ব্লেন্ড করে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে রাখবেন।আলুঃ
আলু যে ফ্রিজে রাখতে নেই—এ কথা অনেকেরই জানা। ফ্রিজে রাখলে আলুর শর্করার গুণাগুণ নষ্ট হয়। আলুতে যে মিষ্টি ভাব থাকে, ফ্রিজের হিমাগার তা শুষে নেয়। এতে আলুর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রিজে রাখার চেয়ে খোলা ঝুড়িতে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় যে কোনও অন্ধকার স্থানে আলু রাখবেন। আলু বাইরে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে।আদাঃ
যদিও আদা ফ্রিজের অতিরিক্ত কম তাপমাত্রাতেও অঙ্কুরিত হতে সক্ষম। তারপরও আদা ফ্রিজে রাখলে স্যাঁতস্যাঁতে ও নরম হয়ে যায়। এর পরিবর্তে আদা বাইরে শুকনো জায়গায় রাখলেই ভালো থাকে। তবে আদা বেটে বা ব্লেন্ড করে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ভরে ফ্রিজে রাখতে পারেন।কুমড়াঃ
কুমড়া একটি সুস্বাদু সবজি। আমাদের দেহের জন্যও খুব ভালো এই সবজিটি। এটি ফ্রিজে না রাখাই ভালো। কারণ বাইরেই এটি কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ দিন রাখা যায়।শাকঃ
যে কোন শাক অন্যান্য খাবারের সঙ্গে থাকলে নিজের ফ্লেভার হারিয়ে ফেলে। ফ্রিজে শাক রাখলে অনেক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, ভাল থাকে না। না পঁচলেও খাওয়ার উপযোগী থাকে না। এরচেয়ে গোড়া পানিতে দিয়ে দু’এক দিন রাখা যেতে পারে। তবে অল্প সময়ের জন্য পলি ব্যাগে করে ফ্রিজে রাখা যেতে পারে।আপেলঃ
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আপেল মিষ্টি আর রসাল থাকে। ফ্রিজে রাখলে পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। এ ছাড়া বাইরের আবরণ শুষ্ক হয়ে যায়। আপেলের রসাল ভাব থাকে না।কিছু কিছু ফল, যেমনঃ
কলা, টক জাতীয় ফল, জাম, পিচেস, এপ্রিকটস্ এবং নেকটারাইন ফ্রিজে রাখা ঠিক না। ফ্রিজে রাখলে এসব ফলের গুণমান নষ্ট হয়। তবে একটু তরতাজা অবস্থায় খাওয়ার জন্য খাওয়ার ঠিক আধাঘণ্টা আগে এসব ফল ফ্রিজে রাখা যেতে পারে। টক জাতীয় পল সহজে নষ্ট হয় না, তবে এগুলো একটির সাথে আরেকটি লাগিয়ে না রেখে সংরক্ষণ করতে হবে।চা-কফিঃ
বায়ু চলাচল করতে পারে না—এমন কনটেইনারে কফি রাখা উচিত। এরা স্বাদ শোষক। ফ্রিজে রাখলে কফি বিন বা পাউডারের আর্দ্রতায় নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রিজে রাখা সমস্ত জিনিসের ফ্লেভার নিয়ে নেওয়ায় কফি বা চায়ের স্বাদ খারাপ হয়ে যায়। এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কফির গন্ধ চলে যায়। এর বদলে একধরনের দুর্গন্ধ তৈরি হয়। তাই চা, কফি ভালো একটি পাত্রে রেখে ঢাকনা দিয়ে ভালোভাবে আটকে রাখুন। এগুলো অনেকদিন ভালো থাকবে।
মধুঃ
মধু কখনোই ফ্রিজে সংরক্ষণ করার দরকার নেই। মধুর মধ্যে থাকা সুগার ঠান্ডা হাওয়ায় কেলাসিত হয়ে যায়, যা মধুর স্বাদ ও গুণাগুণ একদম কমিয়ে দেয়। তাই মধু ফ্রিজের বাইরে রাখাই উচিত।ফ্রিজের বাইরে স্বাভাবিক তাপমাত্রায়ও মধু খুবই মসৃণ এবং তাজা থাকবে। তবে মধু যে পাত্রে রাখবেন তার মুখটি ভালো ভাবে আটকে রাখুন।
পুদিনা পাতাঃ
আপনি যদি পুদিনা পাতা ফ্রিজে রাখেন তাহলে সেগুলোর স্বাদ এবং গন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা তাপমাত্রা তাদের সতেজভাব দ্রুত নষ্ট করে এবং শুষ্ক করে তোলে। পুদিনা পাতা সংরক্ষণের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো সেগুলোকে পানিভর্তি জারে রাখা এবং সেই জারের মুখ খুলে রাখা।তুলসী পাতাঃ
তুলসী পাতা ফ্রিজে রাখলে দ্রুত তার তাজা ভাব হারিয়ে যায়। এটি ফ্রিজে রাখা সব খাবারের গন্ধ শুষে নেয়। আমরা যেভাবে একটা টবে বা কাপে জল দিয়ে ফুল ডুবিয়ে রাখি ঠিক সেভাবেই তুলসী পাতাকে রাখা যেতে পারে। এতে এর সতেজতা বজায় থাকবে।বাদাম এবং শুকনো ফলঃ
আমাদের অনেকেই বাদাম এবং শুকনো ফল ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন এই আশায় যে এতে সেগুলোর স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হবে না বা পঁচে যাবে না। কিন্তু এতে বরং হিতে বিপরীত হয়। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় বরং তাদের স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হয়ে যায় এবং ফ্রিজে থাকা অন্যান্য গন্ধও তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। এরচেয়ে বরং তাদেরকে বায়ুরোধী পাত্রে রেখে খোলা জায়গায় রাখুন।অলিভ অয়েল ও অন্যান্য তেলঃ
অলিভ অয়েল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ করতে পারেন। কখনই কোন ধরনের তেল, ঘি ফ্রিজের বেশি ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় রাখা উচিৎ না। কেননা ফ্রিজে এগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হয়ে পড়ে। ফ্রিজের ঠান্ডা বাতাসে এটি মাখনের মত জমে যায়। এতে তেলের ঘনত্ব বেড়ে যায়। তবে বাদাম তেল ফ্রিজে সংরক্ষণ করা ভাল।মাখনঃ
পাস্তুরাইজড দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় এজন্য মাখন সহজে খারাপ হয় না। বিনা দ্বিধায় শীতল স্থানে মাখন রেখে দিতে পারেন যেন গলে না যায়। কারণ ফ্রিজ মাখনের জলীয় অংশ শুষে নেয়।চিজঃ
আপনি যদি নরম তুলতুলে চিজ খেতে চান তাহলে ভুলক্রমেও একে ফ্রিজে রাখবেন না। কারন চিজ ফ্রিজে রাখলে এর গুন ও মান দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।সস, ভিনেগারঃ
ভিনেগার, সস, সয়াসস, কেচাপ ফ্রিজের বাইরেই ভাল থাকে। এগুলো ফ্রিজে রাখার দরকার নেই।হট সসঃ
ফ্রিজে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটি ৩ বছর পর্যন্ত বাইরে নিশ্চিন্তে রাখা যায়।
শুকনো খাবারঃ
কুড়মুড়ে খাবারগুলো বায়ুরোধক পাত্রে রেখে দিলে ভাল থাকে। এগুলো ফ্রিজে রাখার দরকার নেই।আচারঃ
আচার এমনিতেই ভাল থাকে। আচারের চারপাশে বায়ু চলাচল করলে ভাল হয়। এগুলো ফ্রিজের বাইরে রাখা ভাল।তরমুজঃ
আস্ত তরমুজ ফ্রিজে রাখলে গুণমান নষ্ট হয়, তবে কাটা তরমুজ দুই তিনদিন রাখা যেতে পারে।জামঃ
ফ্রিজে রাখলে গুণমান নষ্ট হয়, তাই এগুলো কিনে দ্রুত খেয়ে ফেলা ভাল।মশলাঃ
মসলা ফ্রিজে রাখতে নেই, তবে বাটা মশলা ফ্রিজে রাখতে হয়, যদিও তাতে ঘ্রাণ ঠিক থাকে না।এছাড়াও শুকনো ফল, শুটকী মাছ, মরিচ এগুলোও ফ্রিজে রাখার দরকার নেই। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এগুলো ভাল থাকে।
মন্তব্যসমূহ